গভীর চোরা স্রোত newchoti

newchoti

নিজেকে বারবার দেখছে স্রোতস্বিনী। ঘরে একা থাকলেই সে এমনটা করে। দেয়ালের বড় আয়নায় নিজেকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করতে থাকে। বিবস্ত্র হয়ে। তার করুণ শঙ্খদ্বয়, তানপুরার মত ভারী নিতম্ব, কোমর ছাপানো চুল, পেলব ত্বক, পাকাগমের মত বর্ণ, তার সাথে কমনীয় চোখজোড়া। নিজের রূপে নিজের এই মুগ্ধতাকে নাকি বলে নার্সিসিজম। সে আবার এক পৌরাণিক কাহিনী।

কিন্তু সে নিজেকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে। চুল একপাশে করে কখনোবা খোঁপা করে। তার মসৃণ বাহুমূলে লেগে থাকা ঘর্মবিন্দু এখনো কেউ শুষে নিচ্ছে না কেন তীব্র আশ্লেষে? কেন কেউ কলম্বাসের মত আবিষ্কার করছে না তার গভীর গোপন অসূর্যম্পশ্যা অরণ্য? নাকি সে দিচ্ছেনা? যদি সুখ খোঁজো এ শরীরে অনায়াসে পাবে। যদি ভালোবাসাও খোঁজো হাতড়ে বেড়াতে হবে মনের তল। কতজনকেই একথা বলেছে দেখা করেছে কফিশপে গিয়ে। কেউ প্রত্যক্ষে কেউবা পরোক্ষে দিয়েছে প্রস্তাব। আবার দেখা হোক কিংবা আমার ঘরটা আজ খালি…! যায়নি সে। প্রথম দেখা হওয়াতেই নিজের দেহ মন অন্যকে সমর্পণ করার ইচ্ছা তার নেই। হয়তো এও এক অভিজ্ঞতা পারতো।

কিন্তু সেটা করার জন্য যে মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ্ব সর্বোপরি বিবেককে জবাবদিহি করতে হতো, এই সকল যুদ্ধকে একা হাতে রোখার শক্তি নেই স্রোতের। এই ছোট্ট নামেই তাকে আমরা ডাকবো নাহয়। কাজে যাওয়ার জন্য এবারে সে প্রস্তুতি নিতে থাকে। বাথরুমে ঢুকেই চালিয়ে দেয় শাওয়ার। সারা শরীর ভিজে যাচ্ছে জলে। কদিন আগেই শেষ হয়েছে মাসিক। তাই মনটা আজ খুশি খুশি। পুরুষেরা কি এসব বোঝে? টের পায়? মনে হয় না। তারা শুধু মাংস বোঝে। কখনো কখনো ঘেন্না হয়, কখনো বা করুণা সহানুভূতি।

অফিসের বস ও তো তাকে কতবার ছলাকলায় প্রস্তাব দিয়েছে সে এড়িয়ে গেছে। চাইনা তার প্রমোশন। চাইনি সে ঠকাতে বসের স্ত্রীকেও। তার নিজের একান্ত আপন কেউ হোক সে চায়। কলেজে থাকাকালীন প্রেম একটা হয়েছিল বটে। একই ব্যাচের। ফাঁকা ক্লাসরুমে কোমর জড়িয়ে গভীর আশ্লেষে দীর্ঘ চুম্বন শেষে, ছেলেটা নেমে আসতে চাইতো বুকের গভীর খাঁজে, প্রত্যাখ্যান ই পেতো শুধু। তাই হয়তো প্রেমটা টেকেনি বেশিদিন। মানুষ কীভাবে যে নিজের ভালোলাগাকে বদলে নিতে পারে সময়ের সাথে সাথে স্রোত বোঝেনা। তাই জন্যে এও শুনতে হয় সে প্রাচীনপন্থী। সে এতেই গর্বিত।

স্নান শেষে প্রস্তুত হতে থাকে। মেরুন একটা কুর্তির সাথে সোনালী লেগিংস। একটা একই রঙের ওড়না, বক্ষযুগলকে দেখিয়ে চলা তার পছন্দ না যে। গাঢ় করে লিপস্টিক পরে নেয়, চোখের পল্লবে কাজল। মোহময়ী লাগছে কি? ভেবে হাসে স্রোত। আদৌ কি কেউ এত খেয়াল করে দেখবে। নিজের জন্য এই সাজাটাই কি সুখকর না? মাঝে মাঝে যখন বিষণ্ণতা ঘিরে ধরে, অনুভব করতে থাকে পুরুষের প্রয়োজন একান্তভাবেই। তার কোমল সরু আঙুলগুলো নেমে যায় এই বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের রহস্যভেদ করতে। মস্তিষ্কে ভেসে ওঠে কিছু দৃশ্যকল্প, তাতে কোনো আক্রোশ নেই, অজাচার নেই, অপ্রকৃতিস্থ যৌনতাও নেই, আছে আলিঙ্গন আদর। পূর্বরাগ। এটুকুই চায় সে। শিহরণটুকুই চায়। সস্তার প্রেম থেকে না। গভীর সম্পর্ক থেকে।

জলখাবারে ওটস, দইআর ফ্রুটস খেয়ে, ফ্ল্যাটে চাবি লাগিয়ে নিচে নামতে যাবে সিঁড়ি দিয়ে দেখে পাশের ফ্ল্যাটে কেউ একজন বোধহয় শিফট হচ্ছেন। দরজা খোলা, জিনিসপত্র ছড়ানো। মালপত্র নিয়ে আসা হচ্ছে সিঁড়ি দিয়েই। আগে তো এই ঘরটা বন্ধই থাকতো। ফ্ল্যাটের মালিক প্রবাসে। ভাড়া দিয়েছেন তাহলে কাউকে। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে নিচে নেমে এসে হেলমেট পরে নেয় আনমনে। হাতের নেলপালিশের শেডটাও ম্যাচ করে গেছে যেন অজান্তেই। স্টার্ট দিতে যাবে এমন সময় এক সুন্দর গন্ধ যেন ঠান্ডা হাওয়ার মত ঝাপটা মারে স্রোতের নাকে। একজন পুরুষ ঘর্মাক্ত দেহে হেঁটে যাচ্ছে শশব্যস্ত হয়ে তার পাশ দিয়ে। দীর্ঘদেহী। যদিও তার মুখাবয়ব দেখা গেল না স্পষ্ট করে তাও কল্পনায় স্রোত ভেবে নিল সুপুরুষই হবেন হয়তোবা। আগে তো দেখেনি একে। তবে কি ইনিই নতুন ভাড়াটে?

আর দেরি না করে অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় স্রোত। পুজো যত এগিয়ে আসছে যানজট বাড়ছে শহরে। তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে হবে গন্তব্যস্থলে। নইলেই চাপ…

অফিসে পৌঁছেই কাজে ডুবে যায় স্রোত। আইটি এর ভাইটি নয়, বোনটি হয়ে চুপচাপ চোখ রেখে চলে ল্যাপটপের পর্দায়। একগাদা অ্যাসাইনমেন্ট এটাসেটার চাপে ভুলেই যায় জাগতিক জিনিস পত্র। লাঞ্চটাইমে অফিস ক্যান্টিনেই খেয়ে নেয় কিছু একটা। মাকে একবার কল করে নেয়। যেন কোটা পূরণ।আবার কাজ মিটিংস -ডেডলাইনস। ঘরে ফিরতে ফিরতে বেজে যায় সাতটা সাড়ে সাতটা। ফিরে একটু বিশ্রাম নিয়েই ডিনারে খিচুড়ি বা চিকেন স্যালাড বানিয়ে নেয়। না থাকলে সরঞ্জাম বাজার আনিয়ে নেয় বাড়িতেই। একলা থাকার ঝক্কি যে কত!

আজও তার এই রুটিনের অন্যথা হলনা। স্কুটিটা যথাস্থানে পার্ক করে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে আবার সে পেলো গন্ধটা। পুরুষালি গায়ের ঘামের গন্ধ আর সোঁদা একটা গন্ধের মিশ্রণ। পারফিউম কি? সিঁড়ি দিয়ে কিছুক্ষণ আগেই উঠেছে কেউ। তার নতুন প্রতিবেশী হয়তোবা। ভাবতে ভাবতে চাবি ঘুরিয়ে লক খোলে ঘরের। আড়চোখে দেখে নেয় অপর পাশের ঘরের দরজাটা আলগা করে ভেজানো। শিফটিং কি এখনো চালু আছে? কে জানে।

কাজের মাসি রাতের দিকে এসে ঘর ঝাঁট দিয়ে বাসন ধুয়ে মুছে যায়। মাঝে মাঝে কুটনোও কেটে দেয়। স্রোত রান্না চাপায় তারপর। ফিরে এসে ভালো করে গা হাত পা ধুয়ে নেয়। বানায় এক কাপ কফি। ক্লান্তি কিছুটা দূর হয়। স্মার্ট টিভিতে ইউটিউবটা চালিয়ে দেয়। নতুন কী একটা গান বেরিয়েছে টি সিরিজের। বেশ লাগে সেই সুরটা। কথা মনে না থাকলেও। মাসি আদৌ আসবে কিনা এত দেরি তো করেনা ভাবতে ভাবতেই কলিংবেল। স্রোত ছুটে গিয়ে দরজা খুলেই ধাক্কা খায়। সেই গন্ধ। আরো তীব্রভাবে। প্রকট তার সামনে। অপরিচিত সেই পুরুষ – যাকে সকালেই সে দেখেছিল। দীর্ঘদেহী। সুপুরুষ কিনা তখন বুঝতে না পারলেও এখন পারছে ভালোই। ছয় ফিটের কাছাকাছি হাইট। গালে হাল্কা ট্রিম করা দাড়ি। টিকালো নাক, উন্নত চিবুক। মুখে একটা অবাঙালি ছাপ স্পষ্ট। হাল্কা ক্রিম কালারের ফতুয়া আর ছাইরঙা ট্রাক প্যান্ট। বেমানান কি? সেসব কিছুই ভাবছেনা। শুধু মনে হচ্ছে তার এই ছেলেটার ঠোঁটটা যেন তাকে কিছু বলছে। সম্বিৎ ফিরলো তক্ষুণি। ক্যাবলা হয়ে যাওয়াটা একেবারেই উচিত হয়নি। স্রোত বলে উঠল আসুন আসুন ভিতরে আসুন। ছেলেটা নামটা আগেই বলেছিল। রোশন। রোশন মুখার্জী। New Neighbour… আলাপ করতে এসেছে তাই। আজই শিফটিং করেছে তো তাই।

স্রোত আর রোশন মুখোমুখি বসল সোফাতে। রোশন ড্রয়িং রুমটা দেখতে দেখতে বলল আপনি বেশ সুন্দর করে সাজিয়েছেন। সো এস্থেটিক।

কথায় কথায় ইংরেজি শব্দ গুঁজে নিজেকে হনু প্রমাণ করতে চাওয়া লোকগুলোকে যদিও স্রোতের অসহ্য লাগতো এদ্দিন, অতি সুপুরুষ ছেলেদের প্রতিও তার একটু এলার্জিই ছিল বলা যায় কারণ তার মনে হতো এরম ছেলেগুলো অনেক মেয়েকেই চড়িয়ে বেড়ায় কিন্তু আপাতত তার এসব কিছুই মনে হচ্ছেনা। বেশ ফুরফুরে একটা হাওয়া বইছে যেন ঘরে। এসির তাপমাত্রা ঠিকই আছে যদিও তবে সেই গন্ধটা জাঁকিয়ে বসেছে।

-আপনি এখনো এলেন কি অফিস করে? আয়াম সো সরি। আমি বিরক্ত করতে এলাম।

– আরে না না কোনো ব্যাপার। চা খাবেন না কফি?

রোশন ঝকঝকে দাঁত বের করে হেসে বলল আরে নাহ কিছু বানাতে হবেনা আপনাকে। আমি ডিনার করেই এসেছি। আমি একটু আগেই ডিনার করে নিই। দিয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাই। সকালে জিমে যেতে হয়তো।

উমম মানে স্বাস্থ্যসচেতন। স্রোত এসবের ধার ধারেনা। ওর চেহারা এমনিই সুন্দর। বাঙালি মেয়েদের যেরম একটা নিজস্ব লাবণ্য থাকে সেরমই। ঢলঢলে চাঁপা কুঁড়ির মত মুখখানি।

স্রোত আচমকাই একটা প্রশ্ন করে বসে- কিছু মনে করবেন না প্রথমে ভেবেছিলাম আপনি নন বেঙ্গলি। হিন্দি বলব বা বাংলা বুঝতে পারছিলাম না।

হা হা করে হেসে ওঠে রোশন।

– হ্যাঁ এরম অনেকেই ভেবে থাকেন। আসলে আমার মা ইউপির মেয়ে। তাই আমার চেহারায় সেই ছাপটা রয়ে গেছে। আমাদের কাপড়ের বিজনেস আছে বেনারসে। আমিও ছোটোবেলায় ওখানেই থাকতাম। তারপর কলকাতাতে আসি ক্লাস ফাইভ সিক্সে পড়ি তখন। এখানেও বাবা শোরুম খোলে বড়বাজারে। আমিও তাই মায়ের সাথে চলে আসি এখানে।Then আমি St Xaviers এ ভর্তি হই। কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে পড়ে একটা ভালো চাকরিও জুটিয়ে ফেলি। আগে দিল্লিতে থাকতাম। ঐ কোম্পানি এখন পোস্টিং দিয়েছে কলকাতায়। কিন্তু কলকাতার ব্যবসায় লোকসান হওয়ার জন্য বাবা মা এখন ফিরে গেছে বেনারসে৷ এখানকার বাড়িঘর ও বেচে দিয়েছে। আর আমার যেহেতু এদিক সেদিক জব পোস্টিং হয় তাই ভাবলাম একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়েই থাকি। বুঝলেন তো?

স্রোত ও আচ্ছা…বলে মাথা নাড়ে।

-আপনিও বলুন আপনার ব্যাপারে।

– আমার বাড়ি হুগলিতে৷ তো ওখানেই পড়াশোনা বেড়ে ওঠা। এখন আইটিতে আছি। তাই আর কী এখান থেকেই যাতায়াত করি। মা মাঝে মাঝে এসে থাকে। আর বাবা মারা গেছেন দু বছর হল।

– আয়াম সো সরি।

– না ঠিক আছে। আপনি কী করে জানবেন?

– ঠিক আছে আজ তাহলে উঠি। ও সরি কথার চোটে আপনার নামটাই তো জানা হয়নি।

– আমি স্রোতস্বিনী রায়৷

– বাপ রে কী কঠিন নাম! এর মানে কী? আমার বাংলাটা একটু পুওর আছে প্লিজ ডোন্ট মাইন্ড।

– এর মানে নদী। কোনো বিশেষ নদী না। এমনিই একটা নদী। আমার বাবা বাংলার শিক্ষক ছিলেন। তারই দেওয়া নাম।

– বাহ বিউটিফুল। তাহলে আপনি একজন নদীর নামের মেয়ে। হা হা…

স্রোতস্বিনী হাসল। কেঠো হাসি। এসব বোকা বোকা ফ্লার্ট তার ভালো লাগেনা। লোকটাকে এবার বিরক্তিকর লাগছে। তাড়াতাড়ি চলে গেলে বাঁচে। কখন হয়তো কাজের মাসি এসে যাবে। ঘরে একটা মেয়ে আর ছেলেকে দেখলে কীসব না রটিয়ে বেড়াবে গোটা অ্যাপার্টমেন্টে তার ইয়ত্তা নেই। যাইহোক রোশন বিদায় নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার মিনিট দশেক বাদেই মাসি এল। গন্ধটা এখনো ঘুরছে ঘরে। রান্না চাপিয়ে স্রোত একবার সোশ্যাল মিডিয়াতে রোশনের নামটা লিখে সার্চ দেয়। পেয়েও যায়। হ্যাঁ ডিটেলস ঠিকই আছে। কোম্পানির নামটা…আরেহ এটা তো তাদেরই মাদার কোম্পানি। মানে ও যদি খুব ভুল না হয়ে থাকে এই সোমবার কি রোশনবাবুই জয়েন করছেন রিজিওনাল ম্যানেজিং ডিরেক্টর হিসেবে? নামটা ও শোনেনি ভালো করে। আজ তো শনিবার। যেচে জিজ্ঞেস ও করা যায়না। মাসি চলে যাওয়ার পর ডিনার করব শুয়ে পড়ল স্রোত। এতদিন ও রবিবারের অপেক্ষা করতো। আজ যেন সোমবার আসার করছে। একটা রহস্য ভেদ। চাইলেই ও কোনো কলিগের থেকে জানতে পারতো। কিন্তু কারুর সাথে সেরম সখ্যতাও নেই এক, আর ২য়ত সে এই সাসপেন্সটা উপভোগ ও করছে। অগত্যা ঘুমের দেশে পাড়ি জমায় স্রোতস্বিনী। আপাতত অপেক্ষা সোমবারের..দেখা যাক কী হয়!

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url